অবাঞ্চিত ও রাক্ষুসে মাছ আপসারন পদ্ধতিঃ
সঠিকভাবে ঘের/পুকুরকে বাগদা চিংড়ির আধা নিবিড় পদ্ধতির চাষের জন্য উপযোগী
করে তুলতে হলে, প্রথমেই পুকুর/ঘেরের অবাঞ্চিত ও রাক্ষুসে মাছ অপসারন করতে হবে।
আমাদের দেশে অধিকাংশ চাষীরা তাদের পুকুর/ঘেরের আবাঞ্চিত ও রাক্ষুসে মাছ দূর করার
জন্য অবলীলায় ফসটক্সিন জাতীয় গ্যাস ট্যাবলেট ও সুমিথিয়ন এর মত ক্ষতিকারক রাসায়নিক
দ্রব্য ব্যবহার করে থাকে। এসব নিষিদ্ধ রাসায়নিক এর রয়েছে মানবদেহের দীর্ঘমেয়াদী
ক্ষতিসাধন করার মত যথেষ্ট সক্ষমতা। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশে এসব
ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিগত ৫-৬ বছরে বাংলাদেশের মৎস্য সেক্টরে বেশ
অগ্রগতি হয়েছে যার ফলে এ দেশের চিংড়ি খামারিরা আগের তুলনায় বেশ সচেতন। তাই সচেতন
খামারিরা তাদের চিংড়ি ঘেরের অবাঞ্চিত মাছ
আপসারন এর জন্য রোটেনন অথবা টি সিড কেক ব্যবহার করে। বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত
কয়েকটি স্বনামধন্য কোম্পানীর রোটেনন যেমনঃ একুরটে(এসিআই), রোটেকিল(নিউট্রিহেলথ), রটেনিল (এসকেএফ) ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে
পারে।
রোটেনন এর ব্যবহারবিধিঃ
৩০-৪০ গ্রাম/শতক/ফুট। রোটেনন এর সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য ঘেরের আয়তন
অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিমান রোটেনন পাউডার এর অর্ধেকটা কাই করে ছোট ছোট দলা বানিয়ে
পানিতে ফেলে দিতে হবে বাকি অর্ধেকটা পানিতে ভালভাবে মিশিয়ে সারা ঘেরে ছিটিয়ে দিতে
হবে। এর পর কিছু সময় পর থেকে রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ মরে ভেসে উঠতে শুরু করবে।
পুকুর/ঘের সংস্কার ও প্রস্তুতিঃ
ঘের প্রস্তুতির সঠিক সময় হল শীতকাল। পরবর্তী বাগদা চিংড়ি চাষ এর সময় আসার আগেই সাধারনত ঘের প্রস্তুতির
কাজ সেরে ফেলা উচিৎ । এ সময় ঘেরের বাঁধ বা পাড় থেকে ঝোপঝাড় অপসারণ করতে হবে। সম্ভব
হলে ঘেরের সম্পূর্ন পানি সেঁচে ফেলে দিয়ে, ঘেরের তলদেশ প্রথম পর্যায়ে একটানা ৭-৮ দিন প্রখর রোদে
শুকিয়ে নিতে হবে । ঘেরের তলদেশের মাটি শুকিয়ে নেয়ার সময় এবং মাটি কিছুটা নরম
থাকাকালীন সময়ে কমপক্ষে ১০-১২ ইঞ্চি মাটি কোদাল অথবা ড্রেজার মেশিন দিয়ে কেটে
ঘেরের বাঁধ ৭-৮ ফুট প্রশস্ত করে মেরামত করতে হবে। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে একটানা
১০-১৫ দিন তলদেশের মাটি রোদে এমনভাবে শুকাতে হবে যাতে ঘেরের তলদেশের মাটি ফেটে
চৌচির হয়ে যায়। নিয়মানুযায়ী এরপরই তলদেশের মাটি চাষ দিয়ে নিতে হবে। এ সময় মাটির
উপর প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন গুলে সব স্থানে ছিটিয়ে দিতে হবে। ঘেরের মাটি যদি
ক্ষয়িষ্ণু হয় তবে পাড় বা বাঁধ মোটা কালো চিকন ফাসের নেট দিয়ে অথবা মোটা পলিথিন
দিয়ে আবৃত করে দিতে হবে। ফলে অতিবৃষ্টি হলেও ঘেরের পাড় ধ্বসে পড়বে না। এ ক্ষেত্রে
অর্থ ব্যয় একটি বিবেচ্য বিষয়। কারন সনাতন পদ্ধতির বাগদা চিংড়ি চাষ এর ক্ষেত্রে একদিকে যেমন কোনপ্রকার আধুনিক
মৎস্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় না অন্যদিকে চাষ সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে অর্থ ব্যয়
ও সংকোচন করা হয়। বাধের চূড়া সাধারনত ৪ ফুট প্রশস্ত হলে ভাল হয়।
পুকুর/ঘেরের পানি ব্যবস্থাপনাঃ
বাগদা চিংড়ি চাষে দক্ষিনাঞ্চলে
বহুল আলোচিত ভাইরাস জনিত সমস্যা দেখা দেওয়ার প্রধান কারনগুলো হল ঘেরের ভাইরাসযুক্ত
পোনা এবং অন্যটি পানির চরম অব্যবস্থাপনা। আধুনিক বাগদা চিংড়ি চাষের সঠিক
জ্ঞান না থাকায় অধিকাংশ চিংড়ি চাষীই
উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর শিকার হন। তাই বাগদা চিংড়ি
চাষে লাভবান হতে হলে, প্রত্যেক চিংড়ি
চাষীকে প্রথমেই ঘেরের পানির ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে হবে। বাগদা চিংড়ির
আধা নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে পানির ব্যবস্থাপনা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কারন ঝুকিমুক্ত
পরিবেশের উপরই চিংড়ির উৎপাদন বহুলাংশে নির্ভর করে। আমাদের দেশে চিংড়ি ঘেরে পানি দেয়ার প্রধান উৎস হল পার্শ্ববর্তী
নদী অথবা খাল কিন্তু আধা নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে এসব উৎস থেকে পানি উত্তোলন এর
ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন পানি উত্তোলনের সময় পাম্পের সন্মুখে
অত্যন্ত ক্ষুদ্র ফাঁস বিশিষ্ট নেট এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যেন ঝুকিপুর্ণ জলজ জীব
বা শেওলা; যা বাগদা চিংড়িকে রোগাক্রান্ত করতে সক্ষম সেগুলোকে আলাদা করতে হবে। এরপর
পানিকে জীবানুমুক্ত করার জন্য ব্লিচিং পাউডার ( ডোজঃ ৬০-৭০ পিপিএম ) অথবা
মানসম্পন্ন জীবানুনাশক {যেমনঃ টিমসেন (ইয়ন), ভাইরুস্নিপ (নোভারটিস), ভাইরেক্স
(এসিআই), মাইক্রোবাইট (নিউট্রিহেলথ), ফার্মসেফ (ক্যাটাপল) ইত্যাদি ব্যবহার করতে
হবে। সাধারনত এসব জীবানুনাশক এর ব্যবহারিক
মাত্রা হল ৪-৫ গ্রাম/ শতাংশ প্রতি ৩ ফুট গভীরতার জন্য। আলাদাভাবে রিজার্ভ চৌবাচ্চা
বা পুকুরের ব্যবস্থা না থাকলে, সেক্ষেত্রে চাষের ঘেরেও সরাসরি পানি উত্তোলন করে এরূপে পানি জীবানুমুক্ত করা যাবে।
তবে প্রাথমিক ভাবে এ পানিতে দ্রবিভূত অক্সিজেন ও প্লাঙ্কটনের পরিমান
একেবারেই কম থাকে তাই পানিতে প্লাংক্টন উৎপন্ন করার জন্য বাজারে প্রচলিত
স্বনামধন্য বিভিন্ন কোম্পানীর প্লাংক্টন মেকিং বিভিন্ন ঔষধ যেমনঃ লাইভফুড
(অ্যাডভান্স এগ্রোটেক), বায়োগ্রো (এস্কাইফ) অথবা সার প্রয়োগ করতে হবে।
সাধারনত এসব প্লাংক্টন মেকারের ব্যবহারিক মাত্রা হল ৪০-৫০ গ্রাম/ শতাংশ প্রতি ৩
ফুট গভীরতার জন্য। অন্যদিকে উপরোক্ত প্লাংক্টন তৈরির ঔষধসমূহ যদি সহজলভ্য না হয়
অথবা ঔষধের খরচ কিছুটা কমাতে হলে
নিন্মোক্ত উপায়ে সার প্রয়োগের মাধ্যমেও পানিতে স্বাভাবিক মাত্রায় প্লাংক্টন তৈরি
করা যায়-
নারিশিং এজেন্ট ও সারের নাম
|
ব্যবহারের মাত্রা (গ্রাম/শতক)
|
ইউরিয়া
|
১০০
|
টিএসপি
|
৫০-১০০
|
সরিষার খৈল
|
১০০
|
চিটাগুড়
|
১০০
|
অটোপালিশ
কুঁড়া
|
১০০
|
ইষ্ট
পাউডার
|
৮০-১০০
|
নারিশিং এজেন্ট ও
সারের ব্যবহারবিধিঃ
উপরে বর্নিত
উপাদানসমূহের মিশ্রন এর তিন থেকে চার গুন পানিতে মিশিয়ে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে, পরে
এই মিশ্রন দিনের বেলায় রোদের সময় প্রয়োগ করতে হবে।
বাগদা চিংড়ির আধা
নিবিড় পদ্ধতির চাষে পানির ভৌত ও রাসায়নিক উপাদানসমূহের আদর্শ মাত্রাঃ
পানির ভৌত ও রাসায়নিক উপাদান
|
আদর্শ মাত্রা অথবা অবস্থা
|
পানির পিএইচ
|
৭.৫-৮.৫
|
দ্রবীভূত অক্সিজেন
|
৫ মিলি গ্রাম/ লিটার
|
অ্যামোনিয়া
|
০.১-০.২ পিপিএম
|
লবনাক্ততা
|
৫-২৫ পিপিটি
|
স্বচ্ছতা
|
২৫-৩৫ সেমি
|
অ্যালকালিনিটি
|
১২০-১৫০ পিপিএম
|
গড় তাপমাত্রা
|
২৬-৩০◦ সেলসিয়াস
|
পানির রঙ
|
সবুজাভ/ বাদামী সবুজ
|